ঈশপের গল্প সমগ্র – এটি শুধু গল্পের সংগ্রহ নয়, বরং হাজার বছরের পুরনো শিক্ষামূলক বুদ্ধির এক বিশাল ভাণ্ডার। গ্রিসের গল্পকার ঈশপ তাঁর অসাধারণ চিন্তাশক্তি দিয়ে এমনসব গল্প রচনা করেছেন, যেগুলো আজও আমাদের শিশুদের মনন ও নীতিবোধ গঠনে সাহায্য করে।
এই ব্লগে আমরা তুলে ধরব ঈশপের সেরা সব গল্প, সেই সাথে গল্পের ব্যাখ্যা এবং গল্প থেকে শিক্ষনীয় উপদেশ। ছোটদের গল্প হিসেবে পরিচিত হলেও, এর শিক্ষামূলক দিক বড়দের জন্যও সমান গুরুত্বপূর্ণ। চলুন শুরু করা যাক।
ঈশপের গল্প সমগ্র কী এবং কেন এত জনপ্রিয়?
ঈশপ (Aesop) ছিলেন প্রাচীন গ্রিসের একজন কাহিনিকার, যিনি খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে বাস করতেন। যদিও তাঁর জীবন সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায় না, তবুও তাঁর নামেই পরিচিত শত শত নীতিশিক্ষামূলক গল্প আজও বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়।
ঈশপের গল্পগুলো মূলত ছোট ছোট প্রাণীদের মাধ্যমে মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং সামাজিক আচরণ তুলে ধরেছে—যেমন: লোভ, ধৈর্য, মিথ্যাচার, সহানুভূতি ইত্যাদি। প্রতিটি গল্পের শেষে থাকে একটি শিক্ষণীয় বার্তা বা নৈতিক শিক্ষা, যা শিশু থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক—সব বয়সী পাঠকের জন্যই মূল্যবান।
ঈশপের গল্প সমগ্রের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো এগুলোর সরলতা ও গভীরতা। ছোট আকারের হলেও প্রতিটি গল্পে থাকে একটি নির্দিষ্ট বার্তা—জীবনের কোনো গুরুত্বপূর্ণ পাঠ, যা দীর্ঘদিন মনে রাখার মতো।
গল্পগুলোর মূল বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:
– সহজ ভাষায় লেখা
– প্রতীকী চরিত্র (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রাণী)
– এক বা একাধিক স্পষ্ট নৈতিক শিক্ষা
– ছোট গল্পে গভীর জীবনদর্শন
– সব সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ
এই বৈশিষ্ট্যগুলোর কারণেই “ঈশপের গল্প সমগ্র” আজও পাঠকের মন জয় করে। এক কথায় বলতে গেলে, ঈশপের গল্প সমগ্র এমন একটি সাহিত্যভাণ্ডার, যেটা সময় পেরিয়েও পুরনো হয় না—বরং নতুন নতুন প্রজন্মের কাছে আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।
ঈশপের গল্প সমগ্র – সেরা কিছু জনপ্রিয় গল্পের তালিকা
নিচে ঈশপের গল্প সমগ্র থেকে সেরা কিছু ছোট গল্প দেয়া হলো।
গল্প – ১ঃ রাজহাঁস এবং সোনার ডিম
কোনো এক স্থানে এক স্বামী ও তার স্ত্রী বাস করত। সেই স্বামী ও স্ত্রীর বা দম্পতির একটি রাজহাঁস ছিল। তাদের কাছে থাকা এই রাজহাঁসটির একটি বিশেষ গুণ ছিল। রাজহাঁসটি প্রতিদিন একটা করে সোনার ডিম পাড়ত। প্রতিদিন একটি করে সোনার ডিম পেয়ে সেই সোনার ডিমের দৌলতে তারা বেশ ধনী হয়ে গেল।
কিন্তু একদিন স্ত্রী তার স্বামীকে বলল, ‘এই রাজহাঁসটা রোজ একটা করে সোনার ডিম পাড়ে। মনে হয় এর পেটে নিশ্চয়ই অনেক সোনার ডিম আছে। হাঁসের পেটটা কাটলেই সব ডিম একসাথে বেরিয়ে আসবে। তাহলে একসঙ্গে আমরা অনেক সোনার ডিম পেয়ে যাবো।
তখন তার স্বামী বলল, “ঠিক বলেছ, তাহলে আমরা রাতারাতি আরও ধনী হয়ে যাব।’ এই বলে লোভী স্বামী একটা ছুরি দিয়ে রাজহাঁসটার পেট কেটে ফেলল এবং রাজহাঁসটা মরে গেল। কিন্তু পেট কেটে দেখা গেল, রাজহাঁসের পেটে কোনো ডিম নেই। এরপর লোভী দম্পতি নিজেদের বোকামির কথা ভেবে মাথা চাপড়াতে লাগল।
রাজহাঁস এবং সোনার ডিম গল্পটির উপদেশ হল– “অতি লোভে তাঁতি ডোবে।”
গল্প – ২ঃ আগে আমাকে তোলো
কোনো এক স্থানের একটি ছেলে একদা নদীতে স্নান করতে গিয়েছিল। স্নান করতে গিয়ে কি করে যেন সে নদীতে ডুবে যাচ্ছিল। নদীর তীরে একটি লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছেলেটি চিৎকার করে বললো – বাঁচাও বাঁচাও আমি ডুবে যাচ্ছি।
লোকটি বললো — সাঁতার না শিখে একা একা নদীতে নামতে গিয়েছিলে কেন? সাঁতার না শিখে এমনি করে কেউ নদীতে নামে ?
ডুবন্ত অবস্থায় ছেলেটি তখন বললো তুমি আমাকে পরে জ্ঞান দিও, এখন আগে আমাকে জল থেকে তোলো, আগে আমাকে বাঁচাও।
আগে আমাকে তোলো গল্পটির উপদেশ হল- “বিপদগ্রস্ত লোককে বিপদ মুক্ত করে তারপর উপদেশ দিতে হয়।”
গল্প – ৩ঃ মধুর কলস ও মাছি
কোনো এক স্থানে একজন দোকানদার বিক্রি করবার জন্য তার দোকানে একটা কলসীতে মধু রেখেছিল। তারপর হঠাৎ কখন যেন মধুর কলসীটা উল্টে গেল। আর সব মধুটাই গড়িয়ে, ছড়িয়ে পড়ল মাটিতে। মধুর গন্ধ পেয়ে ঝাকে ঝাকে মাছির দল এসে সেই মধু খাওয়া শুরু করল। মাছির দল মধু খাচ্ছে তো খাচ্ছেই নড়বার নাম নেই। পেট ভরে মাছিরা মধু খেতে লাগল। আর শেষ ফোঁটা যখন খাওয়া হল তখন উড়তে গিয়ে তারা আর উড়তে পারল না। হঠাৎ উড়তে গিয়ে তার দেখে মধুর ওপর বসে মধু খাওয়ার জন্য তাদের পা মধুতে আটকে গেছে। এবার কি দশা হবে তা বুঝতে পেরে মাছির দল আফশোষ করতে লাগল – কি মূর্খ আমরা মধু খাবার লোভে শেষে প্রাণ হারালাম।
মধুর কলস ও মাছি গল্পটির উপদেশ হল- “ক্ষণিক সুখে মত্ত হলে পরিণাম ভয়াবহ হয়।”
গল্প – ৪ঃ ইঁদুরের পরামর্শ
কোনো এক জায়গায় একদা একদল ইঁদুর বাস করত। আর সেখানেই থাকত একটি হুলো বিড়াল। সেই বিড়ালের অত্যাচারে ইঁদুরেরা একসময় খুব অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। তারা বুঝতে পারে যে একটা কিছু উপায় না করলে এবার বুঝি তাদের ঝাড়ে বংশে নির্মূল হতে হবে। এখন কি করা যায় তাই ঠিক করতে এক সভা বসল ইঁদুরের। সেই সভায় উপায় বাতলাতে যার যা মনে এল সে তাই বলে গেল, কিন্তু কারো প্রস্তাবই তেমন মনঃপূত হলো না। অবশেষে এক বিজ্ঞ ইঁদুর বলল, আমি বলি কি ঐ বিড়ালের গলায় একটা ঘন্টা বেঁধে দেওয়া হোক – তাহ’লে ঘন্টার আওয়াজ শুনেই আমরা সাবধান হয়ে যেতে পারবো।
সর্বসম্মতিক্রমে বিজ্ঞ ইঁদুরটির প্রস্তাবে সকল ইঁদুরই রাজী হয়ে গেল। কিন্তু এতক্ষণ ধরে এক বৃদ্ধ ইঁদুর চুপ করে বসে বসে সব শুনছিল। এবার আর সে চুপ করে থাকতে পারল না, বৃদ্ধ ইঁদুরটি বলল – আমার প্রবীণ বন্ধু যা বললেন, সে খুবই বুদ্ধির কথা বটে, বিড়ালের গলায় ঘন্টা বেঁধে দিতে পারলে আমাদের ইষ্ট সিদ্ধ হয় ঠিকই, কিন্তু আমার জিজ্ঞাসা হচ্ছে ঐ ঘণ্টাটা বিড়ালের গলায় বাঁধতে যাবে কে ?
বৃদ্ধ ইঁদুরটির কথার গুরুত্ব ছিল। তাই বৃদ্ধ ইঁদুরটির কথা শুনে অন্যান্য ইঁদুররা আর কোনো উত্তর দিতে না পেরে একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল।
ইঁদুরের পরামর্শ গল্পটির উপদেশ হল- “কোনো বিষয়ে প্রস্তাব দেওয়ার চেয়ে বিষয়টাকে বাস্তবে রূপায়িত করা বেশি কঠিন।”
গল্প – ৫ঃ জাবনার পাত্রে কুকুর
একদা কোনো এক স্থানের এক গৃহস্থের বাড়িতে একটা ঘোড়া ছিল। গৃহস্থ লোকটি প্রতিদিন ঘোড়ার জাবনা খাওয়ার পাত্রে তার জন্য ঘাস ছোলা ইত্যাদি সাজিয়ে রাখতো। অন্য দিনের মতো সেদিনও গৃহস্থ লোকটি জাবনার পাত্রে ঘোড়ার জন্য ঘাস ছোলা ইত্যাদি সাজিয়ে রেখেছিল। কিন্তু সেদিন দেখা গেল একটা কুকুর গিয়ে ঘোড়ার জাবনার সেই পাত্রে শুয়ে রয়েছে। ঘোড়া যখনই খাবার খেতে যায় তখনই সে দাঁত বের করে ঘেউ ঘেউ করে তাকে কামড়াতে যায়। কুকুরের এই আচরণে ভয় পেয়ে ঘোড়াটি তখন পালিয়ে যায়। তখন ঘোড়াটি মনে মনে ভাবে এমন অদ্ভুত স্বভাব তো কারো কখনো দেখিনি। সে ভাবে কুকুরের নিজের খাবার এ সব তো নয়, তাই নিজে খেতে পারবে না। কিন্তু যার খাবার তাকেও সে খেতে দেবে না।
জাবনার পাত্রে কুকুর গল্পটির উপদেশ হল- “খল স্বভাবের মানুষেরা নিজে তো কিছু করবেই না উপরন্তু অপরে কিছু করতে গেলে বাধা দেবে।”
গল্প – ৬ঃ একটি মুক্তো ও মুরগী
কোনো এক স্থানে একটি মুরগী ছিল। তার অনেকগুলি বাচ্চা ছিল। একদিন মুরগীটি খামারে তার বাচ্চাদের নিয়ে খাবার খুঁজতে গিয়েছিল। হঠাৎ মুরগীটির নজরে পড়ল একটা মুক্তো। মুরগীটি তখন মুক্তোটির কাছে গিয়ে বলতে লাগলো, তোমাকে সবাই কত আদর করে। তুমি শুধু সুন্দর নও, তুমি অতি মূল্যবান বস্তু। কিন্তু আমার কাছে? না না আমার কাছে তোমার অতটা মূল্য নেই। সত্যি করে বললে বলতে হয়, আমার কাছে তুমি একেবারে নিতান্ত তুচ্ছ জিনিস। পৃথিবীতে যত, মুক্তো আছে, সেসব পাওয়ার চেয়ে, একটি যব, ধান বা কলাইয়ের দানা পেলে আমি মহাখুশি হই। অতএব যেখানকার মুক্তো সেখানেই পড়ে রইল।
একটি মুক্তো ও মুরগী গল্পটির উপদেশ হল – “রতনে রতন চেনে, শুয়োরে চেনে কচু।
গল্প – ৭ঃ কাঠুরে ও জলদেবতা
একদা কোনো এক স্থানে এক কাঠুরে ছিল। সেই কাঠুরে ছিল বড়ই গরীব। একদিন সেই কাঠুরে নদীর ধারে একটি গাছ থেকে কাঠ কাটছিল। কাঠ কাটতে কাটতে কি করে যেন তার কুড়ুলটি হাত ফসকে জলে পড়ে গেল। বেচারা কাঠুরের আর কাঠ কাটা হলো না। তাছাড়া সে চিন্তায় পড়ে গেল। কারণ তার একমাত্র কুড়ুলটি জলে পড়ে যাওয়ায় এখন সে খাবার জোটাবে কি করে? তাই মনের দুঃখে সে নদীর তীরে বসে কাঁদতে শুরু করলো।
কাঠুরের কান্না শুনে জলদেবতা তার সামনে আবির্ভূত হয়ে বললেন – কি হয়েছে, বাপু তোমার? তুমি কাঁদছো কেন?
তখন কাঠুরে তার দুঃখের কথা খুলে বলল। কাঠুরের দুঃখের কথা শুনে জলদেবতা করুণাপরবশ হয়ে তখনই নদীতে ডুব দিয়ে একখানা সোনার কুড়ুল তুলে নিয়ে এসে তার সামনে ধরে বললেন – দেখো তো, এটি কি তোমার কুড়ুল?
সোনার কুড়ুলটি দেখে কাঠুরেটি বলল – আজ্ঞে না, এটি আমার কুড়ল না। কাঠুরের কথা শুনে জলদেবতা আবার ডুব দিলেন নদীতে। সেখান থেকে এবার তুলে আনলেন একখানা রূপোর কুড়ুল।
জলদেবতা রূপোর কুড়ুল দেখিয়ে কাঠুরে কে বলল – দেখো তো এটি কি তোমার?
কাঠুরেটি বলল — আজ্ঞে না, এটিও আমার নয়।
জলদেবতা আবার ডুব দিলেন নদীতে, এবার তুলে আনলেন তিনি কাঠুরের নিজের সেই কুড়ুলটি যেটি জলে পড়ে গিয়েছিল। সেই কুড়ুলটি দেখিয়ে জলদেবতা বলল – দেখ তো চেয়ে এবার, এটি কি তোমার?
কাঠুরে এবার আনন্দের সঙ্গে চিৎকার করে বলে উঠলো -আজ্ঞে হ্যাঁ, এটি আমার কুড়লই বটে।
জলদেবতা কাঠুরের এই সাধুতায় এত খুশি হলেন যে কাঠুরের নিজের কুড়ুলের সঙ্গে আগের সেই (সোনা ও রূপোর) দুটি কুড়ুলও কাঠুরকে উপহার দিয়ে মিলিয়ে গেলেন।
কাঠুরে কাঠ কেটে ফিরে এসে তার অন্যান্য বন্ধু কাঠুরের কাছে যখন এই অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা খুলে বললো তখন তাদের মধ্যে একজন ভাবলো – আরে, আমিও তো এমনি করেই সোনার কুড়ুল পেতে পারি।
সেই কাঠুরেটি তখনই নদীর ধারে এসে কাঠ কাটবার ছল করে ইচ্ছে করে তার কুড়ুলটি নদীর জলে ফেলে দিল। তারপর নদীর তীরে বসে কাঁদতে লাগল। তার কান্না শুনে জলদেবতা তার সামনে এসে কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করে যখন শুনলেন নদীতে তার কুড়ুল পড়ে যাওয়ায় সে কাঁদছে, তখন তিনি আগের মতোই নদীতে ডুব দিয়ে একখানা সোনার কুড়ুল এনে তার সামনে ধরে বললেন – দেখো তো এই কুড়ুলটি তোমার কিনা।
সোনার কুড়ুল দেখে লোকটা লোভ সামলাতে পারলো না। লোকটি বলল – হ্যাঁ, হ্যাঁ, এটা ত আমার কুড়ুলই বটে। জলদেবতা তাকে নির্লজ্জের মতো মিথ্যা কথা বলতে শুনে খুব রেগে গেলেন। তিনি সোনার কুড়ুলখানা তো দূরের কথা তার আসল কুড়ুলটাও তাকে ফিরিয়ে না দিয়ে তখনই অদৃশ্য হয়ে গেলেন। লোকটি নদীর তীরে বসে হতাশ হয়ে কাঁদতে লাগল। কিন্তু জলদেবতার আর দেখা পেলেন না।
কাঠুরে ও জলদেবতা গল্পটির উপদেশ হল– “সৎ কাজের পুরস্কার এবং অসৎ কাজের জন্য দণ্ড পেতে হয়।”
গল্প – ৮ঃ একটি দাঁড়কাক ও অন্য কাকেরা
কোনো এক স্থানে একটি দাঁড়কাক ছিল। নিজের জাতভাই অন্যান্য কাকদের চেয়ে সে ছিল বেশ জমকালো আর বড়সড় দেখতে। তাই সে একদিন নিজের জাত ভাইদের অবহেলা করে বড় কাকদের কাছে গেল। বড় কাকদের কাছে গিয়ে বললো—ভাই আমি তোমাদেরই একজন তাই আমাকে তোমাদের দলে নাও।
বড় কাকের দল দেখল তাদের সঙ্গে এর কোনো কিছুতেই মিল নেই, না চেহারায়, না গলায় স্বরে। তাই বড় কাকের দল, দাঁড়কাকটিকে বলল—যাও, দূর হও এখান থেকে— বেশি ফ্যাচফ্যাচ না করে এখান থেকে মানে মানে কেটে পড়ো। বড় কাকের দলের কাছে আঘাত পেয়ে দাঁড়কাকটি যখন তার জাতভাইদের কাছে ফিরে এলো, তখন তারাও তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল। জাতভাইরা বললো, তুমি আমাদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে, ঘৃণা করে ত্যাগ করে গিয়েছিলে আবার আমাদের কাছে এসেছো, তোমার লজ্জা করছে না? দূর হয়ে যাও আমাদের সামনে থেকে। এই ভাবে দাঁড়কাকটি দুই জায়গাতেই অপমানিত হল।
একটি দাঁড়কাক ও অন্য কাকেরা গল্পটির উপদেশ হল– “নিজের বংশ পরিচয় দিতে কোনো সঙ্কোচ করতে নেই।”
গল্প – ৯ঃ ঘোড়ার ছায়া
কোনো এক দেশে এক ব্যক্তির একটা ঘোড়া ছিল। লোকটি ঐ ঘোড়া ভাড়া দিয়ে তার সংসার চালাতো। গ্রীষ্মকালের একদিন একটা লোক পথ চলতে চলতে বড় ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং ঐ ঘোড়াটা ভাড়া করল। ঘোড়া ভাড়া করে তার উপরে কিছুক্ষণ চড়ে প্রচণ্ড রৌদ্রের তেজ সহ্য করতে না পেরে ঘোড়া থেকে নেমে সেই ঘোড়ার ছায়ায় বসল।
এই দৃশ্য দেখে যার ঘোড়া সে এগিয়ে এসে বলল একি, তুমি আমার ঘোড়ার ছায়ায় বসছো কেন, সরো, সরো, এ আমার ঘোড়া এর ছায়ায় আমিই বসবো। তখন যে ঘোড়া ভাড়া নিয়েছিল সে বলল – বাঃ রে, সারা দিনের জন্য আমি তোমার ঘোড়া ভাড়া নিয়েছি আমি বসবো না তো কি ছায়ায় তুমি বসবে?
লোকটির কথা শুনে যার ঘোড়া সে বলল – ঘোড়া তোমায় ভাড়া দিয়েছি ঠিকই, কিন্তু তার ছায়া তো আর ভাড়া দিইনি। এমনি করে দু’জন কথা কাটাকাটি করতে করতে শেষে মারামারি শুরু করলো। আর সেই অবসরে সুযোগ পেয়ে ঘোড়া সেখান থেকে দিল ছুট। এরপর অনেক খুঁজেও ঘোড়াটার আর সন্ধান পাওয়া গেল না।
ঘোড়ার ছায়া গল্পটির উপদেশ হল– “অনেক তুচ্ছ জিনিস নিয়ে ঝগড়া করতে গিয়ে প্রচুর ক্ষতি হয়ে যায়।”
গল্প – ১০ঃ সিংহ ভাগ
একদা কোনো এক বনে এক সিংহ বাস করতো। সে ছিল বনের রাজা। আর সেই বনেরই অপর প্রান্তে তৃণভোজী এক বন্য গাধা বাস করতো। কি জানি কেমন করে যেন সেই সিংহের সঙ্গে গাধার বন্ধুত্ব হয়ে গেল। বন্ধুত্ব হওয়ায় একদিন সিংহ ও সেই বুনো গাধা একসঙ্গে শিকারে বেরোলো। সিংহ ও গাধা দু’জনেই শিকার করছিল। সিংহ শিকার করছিল তার গায়ের জোরে, আর গাধা শিকার করছিল তার পায়ের জোরে দৌড়ে। এমনি করেই শিকার করতে করতে কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা বেশ কিছু জন্তু মারল। এবার সেই শিকার করা জন্তুর ভাগের পালা। এই ভাগের কাজটি সিংহ নিজের হাতে নিল। সিংহ মারা জন্তুগুলো মোট তিনটি সমান ভাগে ভাগ করল। ভাগ করার পর সিংহ বলল – আমি বনের রাজা, তাই প্রথম ভাগটা আমিই নিচ্ছি এবং শিকারে তোমার অংশীদার হিসেবে দ্বিতীয় ভাগটার পাওনাও আমার. আর বাদ বাকী যে ভাগটা রইল সেটা যদি তুমি নিজে থেকেই ছেড়ে দাও তো ভাল তা নাহলে তোমায় মহা বিপদে পড়তে হবে তা আমি আগে থাকতেই তোমায় বলে রাখছি।
সিংহ ভাগ গল্পটির উপদেশ হল– “দুর্বলে এবং বলবানে কোনো যৌথ কাজ চলতে পারে না।”