কর্মক্ষেত্রে আপনার professional image বা পেশাদার ভাবমূর্তি অনেকাংশেই নির্ভর করে আপনার যোগাযোগের ধরনের ওপর। আপনার বসের সাথে আপনার কথাবার্তা যেমন বিশ্বাস তৈরি করতে পারে, ঠিক তেমনি ধীরে ধীরে তা নষ্টও করে দিতে পারে। অনেক সময় হয়তো আপনার উদ্দেশ্য ভালো, কিন্তু কিছু কথা অসতর্ক, অপেশাদার বা অসম্মানজনক শোনাতে পারে। এই ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে, এখানে এমন কিছু কথা তুলে ধরা হলো যা আপনার বসকে কখনোই বলা উচিত নয়, এবং তার পরিবর্তে কী বলা যেতে পারে তার কিছু পরামর্শ দেওয়া হলো।
১. “আমার আগের অফিসে তো এভাবেই করতাম।” অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে নতুন ধারণা দেওয়া ভালো, কিন্তু বর্তমান কর্মক্ষেত্রের সাথে আগের অফিসের তুলনা করলে মনে হতে পারে আপনি পরিবর্তন চান না বা বর্তমান নিয়মকে অবহেলা করছেন।
এর চেয়ে ভালো উপায়: “আমি আগের প্রতিষ্ঠানে অন্য একটি পদ্ধতিতে কাজটা শিখেছিলাম। আপনি যদি চান, আমি তা শেয়ার করতে পারি, হয়তো এখানেও তা কাজে আসতে পারে।”
২. “এই কাজের জন্য তো আমাকে বেতন দেওয়া হয় না।” এই ধরনের কথা বললে মনে হয় আপনি কোনো বাড়তি দায়িত্ব নিতে বা উদ্যোগী হতে ইচ্ছুক নন। কাজটি হয়তো আপনার মূল দায়িত্বের অংশ নয়, কিন্তু পেশাদারিত্বের অর্থ হলো সমস্যার সমাধান করা, এড়িয়ে যাওয়া নয়।
এর চেয়ে ভালো উপায়: “আমি যতটুকু পারি সাহায্য করতে রাজি আছি, তবে কাজটা সঠিকভাবে করার জন্য আপনার নির্দেশনা প্রয়োজন হবে।”
৩. “আমার হাতে এখন অনেক কাজ।” কাজের চাপে থাকাটা স্বাভাবিক, কিন্তু সরাসরি এভাবে বললে মনে হতে পারে আপনি সহযোগিতা করতে চাইছেন না।
এর চেয়ে ভালো উপায়: “আমি বর্তমানে X এবং Y কাজ দুটি নিয়ে ব্যস্ত আছি। এই নতুন কাজটিকে কি সেগুলোর চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে? নাকি আগেরগুলো শেষ করে এটা ধরব?”
৪. “আমার ভুল হয়েছে।” এটি একটি অনানুষ্ঠানিক বা Casual কথা, যা অফিসের জন্য অতিরিক্ত সরল। পেশাদার পরিবেশে নিজের ভুলের দায়ভার আরও বেশি পরিপক্বতার সাথে নেওয়া উচিত।
এর চেয়ে ভালো উপায়: “ভুলটির জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী এবং এর সম্পূর্ণ দায়ভার আমি নিচ্ছি। আমি এটি সমাধান করছি এবং নিশ্চিত করছি যেন ভবিষ্যতে এমন আর না হয়।”
৫. “আমি না থাকলে আপনার কী যে হতো!” মজা করে বললেও এই ধরনের কথা অহংকারী এবং আত্মকেন্দ্রিক শোনায়। আত্মবিশ্বাস থাকা ভালো, কিন্তু অহংকার নয়।
এর চেয়ে ভালো উপায়: “এই দলের একজন সদস্য হিসেবে অবদান রাখতে পেরে আমি আনন্দিত।”
৬. “এটা এমন কী বড় ব্যাপার?” এই কথাটি যেকোনো বিষয়ের গুরুত্বকে কমিয়ে দেয় এবং আপনার দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দেয়।
এর চেয়ে ভালো উপায়: “আমি বিষয়টি বুঝতে পেরেছি। আমি খেয়াল রাখব যেন পরেরবার থেকে কাজটি আরও সতর্কতার সাথে করা হয়।”
৭. “এটা তো আমার কাজ না।” খুব কম কথাই আপনার পেশাদার ভাবমূর্তিকে এর চেয়ে দ্রুত নষ্ট করতে পারে। এই কথাটি আপনার বসকে জানায় যে আপনি দলের সাফল্যের চেয়ে নিজের কাজের সীমানাকে বেশি গুরুত্ব দেন।
এর চেয়ে ভালো উপায়: “যদিও এটা আমার নিয়মিত কাজের অংশ নয়, আমি সাহায্য করতে পারি। অথবা, এই কাজটি সবচেয়ে ভালো পারবেন এমন কাউকে আমি সাজেস্ট করতে পারি।”
৮. “আমি আজ খুবই অসুস্থ বোধ করছি কারণ কাল রাতে পার্টি করেছি।” কখনোই এমন ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করবেন না যা আপনার পেশাদারিত্বকে ক্ষুণ্ণ করে। অফিসের বাইরে আপনি কী করছেন তা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার, কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে যেন তা আপনার কাজে প্রভাব না ফেলে।
এর চেয়ে ভালো উপায়: যদি আপনার শরীর খারাপ লাগে, শুধু বলুন, “আজ আমার শরীরটা ভালো লাগছে না, তবে আমি আমার সেরাটা দিয়ে কাজ করার চেষ্টা করব।”
৯. “আমি কি আজ তাড়াতাড়ি যেতে পারি? একটা ইন্টারভিউ আছে।” সততা প্রশংসার যোগ্য, কিন্তু চাকরির অফার হাতে না পাওয়া পর্যন্ত এই বিষয়টি গোপন রাখাই শ্রেয়।
এর চেয়ে ভালো উপায়: প্রয়োজনে ব্যক্তিগত ছুটি নিন, কিন্তু কারণ উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকুন।
১০. “শুনেছি X আপনার ব্যাপারে Y বলছিল।” অফিসের গুজব বিষাক্ত, এবং এর অংশ হয়ে আপনি সমস্যাটিকে আরও বাড়িয়ে তুলছেন।
এর চেয়ে ভালো উপায়: পেশাদার থাকুন এবং অন্যের পেছনে কথা বলা এড়িয়ে চলুন। যদি বিষয়টি সরাসরি কাজের ওপর প্রভাব ফেলে, তাহলে এইচআর (HR) বিভাগের কাছে রিপোর্ট করুন।
১১. “আপনার কাজ তো আমিই করতে পারি, এটা তেমন কোনো কঠিন কাজ না।” মজা করেও এই ধরনের কথা বলা অসম্মানজনক শোনায়। একজন লিডারের দায়িত্ব আপনি বাইরে থেকে যা দেখেন তার চেয়ে অনেক বেশি।
এর চেয়ে ভালো উপায়: সম্মান ও কৌতূহল দেখান: “আমি আপনার কাজ সম্পর্কে আরও জানতে আগ্রহী। আপনি কীভাবে [নির্দিষ্ট দায়িত্ব] সামলান, তা শিখতে পারলে ভালো হতো।”
১২. “আমার খুব বোরিং লাগছে।” কাজে একঘেয়েমি লাগার কথা বলা আপনার অনীহা প্রকাশ করে। এটি এটাও বোঝায় যে আপনি নিজে থেকে শেখার বা উন্নতি করার জন্য সচেষ্ট নন।
এর চেয়ে ভালো উপায়: “আমার হাতে কি এমন কোনো অতিরিক্ত প্রজেক্ট বা কাজ আসতে পারে, যা দিয়ে আমি নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পারি এবং নতুন কিছু শিখতে পারি?”
১৩. “অন্য কিছু না পাওয়া পর্যন্ত আপাতত এই চাকরিটা করছি।” কোনো বসই এই কথা শুনতে চান না। এটি মুহূর্তের মধ্যে আপনার প্রতি তার বিশ্বাস নষ্ট করে দেবে।
এর চেয়ে ভালো উপায়: আপনি যেখানে আছেন, সেখানে নিজের সেরাটা দেওয়ার ওপর মনোযোগ দিন। আপনি চাকরি বদলানোর পরিকল্পনা করলেও পেশাদারিত্ব বজায় রাখা জরুরি।
১৪. “এই কাজের জন্য আমি বেশিই যোগ্য।” এই কথাটি আপনাকে অহংকারী এবং দলের অন্য সদস্যদের প্রতি অশ্রদ্ধাশীল হিসেবে উপস্থাপন করে। যদি আপনি মনে করেন আপনার পদোন্নতি প্রয়োজন, তবে তা কথার মাধ্যমে নয়, কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করুন।
এর চেয়ে ভালো উপায়: “যদি কোনো চ্যালেঞ্জিং কাজ করার সুযোগ থাকে, আমি তা নিতে আগ্রহী।”
১৫. “আপনাকে আজ বেশ… লাগছে।” বসের বাহ্যিক রূপ নিয়ে কোনো মন্তব্য করা (তা ইতিবাচক বা নেতিবাচক যাই হোক না কেন) ব্যক্তিগত সীমানা লঙ্ঘন করতে পারে বা ভুলভাবে উপস্থাপিত হতে পারে।
এর চেয়ে ভালো উপায়: পেশাদার প্রশংসা করুন: “আপনার আজকের প্রেজেন্টেশনটা অসাধারণ ছিল।”
১৬. “আমি ধারণা করেছিলাম যে…” অনুমান প্রায়শই ভুলের কারণ হয়। তাই অনুমান না করে हमेशा বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে নিন।
এর চেয়ে ভালো উপায়: “কাজটা শুরু করার আগে আমি বিষয়টি পরিষ্কার করে নিতে চাই—আপনি কি চান আমি এভাবেই কাজটা করি?”
১৭. “কিছু মনে করবেন না, কিন্তু…” যদি আপনার কথা শুরু করার আগে এই বাক্যটি ব্যবহার করার প্রয়োজন হয়, তাহলে সম্ভবত আপনার পরের কথাটি আক্রমণাত্মক বা অপ্রীতিকর হতে পারে।
এর চেয়ে ভালো উপায়: আপনার মতামত কৌশলগত ভাবে দিন: “আমি কি এই বিষয়ে ভিন্ন একটি দৃষ্টিকোণ তুলে ধরতে পারি?”
১৮. “আমার মনে হয় X-এর আমাদের সাথে কাজ করা উচিত না।” যদি না আপনি ম্যানেজার পদে থাকেন, তবে এই ধরনের মন্তব্য করা বিচারমূলক বা গুজব ছড়ানোর মতো শোনাতে পারে।
এর চেয়ে ভালো উপায়: যদি আপনার কোনো যুক্তিসঙ্গত উদ্বেগ থাকে, তবে তা ব্যক্তিগতভাবে এবং তথ্য সহকারে বলুন: “আমি X-এর সাথে কাজ করার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা লক্ষ্য করেছি। আপনি যদি চান, আমি নির্দিষ্ট উদাহরণসহ আলোচনা করতে পারি।”
১৯. “দুঃখিত, আমি ইন্টারভিউতে মিথ্যা বলেছিলাম।” এটি ক্যারিয়ার শেষ করে দেওয়ার মতো একটি স্বীকারোক্তি। এর পরিবর্তে, যদি আপনি কোনো দক্ষতায় দুর্বল হন, তবে তা স্বীকার করে উন্নতি করার চেষ্টা করুন।
এর চেয়ে ভালো উপায়: “আমি বুঝতে পেরেছি যে [নির্দিষ্ট স্কিল]-এর ওপর আমার আরও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। এই বিষয়ে উন্নতি করার জন্য আমি কি কোনো সাহায্য বা রিসোর্স পেতে পারি?”
২০. “যদি X হয় (বা না হয়), তাহলে আমি চাকরিটা ছেড়ে দেব।” আলটিমেটাম বা চরম শর্তারোপের ফল সাধারণত ভালো হয় না। এটি আপনাকে অসহযোগী এবং অপরিপক্ব হিসেবে দেখায়।
এর চেয়ে ভালো উপায়: “আমি এই পরিস্থিতিটা কীভাবে সবার জন্য আরও সহজ করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করতে চাই।”
২১. “আপনি কি কাজটা X-কে দিয়ে করাতে পারেন?” নিজের কাজ অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়া আপনাকে অলস বা অসহযোগী হিসেবে পরিচিত করতে পারে।
এর চেয়ে ভালো উপায়: “আমি কাজটা করতে পারব, কিন্তু আমরা যদি একসাথে কাজটা করি তাহলে হয়তো আরও দ্রুত হবে। আমি X-এর সাথে সমন্বয় করে নিতে রাজি আছি।”
২২. “আমি কি আপনার কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিতে পারি?” ব্যক্তিগত আর্থিক বিষয় কর্মক্ষেত্রে আনা উচিত নয়। বসের কাছ থেকে টাকা ধার নিলে পেশাদার সম্পর্কের সীমা নষ্ট হতে পারে।
এর চেয়ে ভালো উপায়: আর্থিক সাহায্যের জন্য পরিবার, বন্ধু বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শরণাপন্ন হোন, কর্মক্ষেত্রে নয়।
২৩. যেকোনো ধরনের স্ল্যাং বা গালিগালাজ অপ্রচলিত শব্দ, স্ল্যাং বা গালিগালাজ আপনার পেশাদারিত্বকে মুহূর্তেই কমিয়ে দেয়, এমনকি কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ অনানুষ্ঠানিক হলেও।
এর চেয়ে ভালো উপায়: আপনার কথা বলার ভঙ্গি স্বাভাবিক রাখুন, কিন্তু ভাষা যেন পরিচ্ছন্ন হয়। সম্মান দেখানো সবসময়ই প্রশংসার যোগ্য।
কর্মক্ষেত্রে আপনার ব্যবহৃত প্রতিটি শব্দের শক্তি আছে। আপনার বস এবং সহকর্মীরা আপনার আচরণ, পেশাদারিত্ব এবং নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে যে ধারণা তৈরি করেন, তার পেছনে আপনার কথার বড় ভূমিকা থাকে। তাই সম্মান, স্বচ্ছতা এবং বিনয়ের সাথে কথা বলুন, এমনকি যখন আপনি কোনো বিষয়ে একমত নন বা মানসিক চাপে আছেন। লক্ষ্য নিখুঁত হওয়া নয়, লক্ষ্য হলো thoughtful বা চিন্তাশীল হওয়া। কারণ দীর্ঘমেয়াদে, পেশাদারিত্ব শুধু আপনার কাজের ওপর নয়, আপনার কথার ওপরেও নির্ভর করে।
We accept:
Onsus.© 2023. All right reserved – Designed by Themesflat